Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

রামপালের ইতিহাস
সেন সভ্যতা ও বাংলার রাজধানী রামপাল

বাংলার ইতিহাস অনুসন্ধান করতে যেয়ে বাংলার প্রাচীন মানসিক রূপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বিক্রমপুর চোখ-১ আলোচনায় পালবংশের উদ্ভবের কথা নবম শতাব্দী থেকে ধরা হয়েছে। পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপাল পাল থেকে শুরু করে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত পালবংশ বিক্রমপুর শাসন করে। দ্বিতীয় শূরপালের সহোদর রামপাল তার নামানুসারেই রামপাল গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে সেন বংশোদ্ভহত বিক্রম সেনই বিক্রমপুর নগরের স্থাপয়িতা। ঐতিহাসিকরা আরও বলেন, রামপাল প্রতিষ্ঠার পর পরই বিক্রমপুর পরগনার নামের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। বিক্রমপুরের ধারাবাহিক শাসনামলের ইতিহাস লিখিত বা সংরক্ষিত না থাকায় নবম শতাব্দীর পূর্বে অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব তিনদশক থেকে অষ্টম শতাব্দী পর্যন্ত বিক্রমপুর পরগনার অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন তথ্য সত্য নির্ভর করে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। এই সময় বিক্রমপুরের কি নাম ছিল? কোন জনপদ ছিল না কিনা? এখানকার আর্থ-সামাজিক অবস্থা, ভাষা, শিল্প-বাণিজ্যের প্রসার, শিক্ষা, ধর্ম, উৎপাদন পদ্ধতি, শ্রমজীবী মানুষের জীবনাচরণ এবং বাংলার রাষ্ট্রীয় পারিকল্পনা কি পর্যায়ের ছিল তা অনুমান করা কষ্টসাধ্য। শুধু পৌরাণিক বেদ ও মনুসংহিতার উপর নির্ভর করে বলা যায়, বঙ্গ নামে একটি দেশ ছিল এবং তখন বঙ্গদেশ অরণ্যসঙ্কুল ও অনার্যগণের আবাসভূমি ছিল। কারা বাংলাদেশের প্রাচীনতম অধিবাসী, আর বাঙালীর রক্তে কোন রক্ত কতটা আছে এ বিচার নৃ-বিজ্ঞানের।

নৃ-বিজ্ঞানের মতে বাংলার প্রাচীনতম অধিবাসীরা ছিলেন অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর অষ্ট্রো এশিয়াটিক জাতির মানুষ। অষ্ট্রিক গোষ্ঠী ছাড়াও বাংলাদেশে বাস করতেন দ্রাবড়ি গোষ্ঠীর বিভিন্ন শাখার লোকেরা। অষ্ট্রো এশিয়াটিক ও দ্রাবিড় ভাষীরা ছাড়াও পূর্ব ও উত্তর বাংলায় বহু পূর্বকাল থেকে নানা সময়ে এসেছিলেন মঙ্গোলীয় বা ভোট-চীনা গোষ্ঠীর নানা জাতি-উপজাতি। অতএব, শুধু নানা ভাষাই যে এই বাংলাদেশে প্রাচীনতম কালে চলত তা নয়, দেশটি ছিল, নানা জাতি উপজাতিদের বাসভূমি। ‘রাঢ়’, ‘সুক্ষ’, ‘পুন্ড’, ‘বঙ্গ’, প্রভৃতি প্রাচীন শব্দগুলো প্রথম দিকে বোঝাতে বিশেষ বিশেষ জাতি বা উপজাতিকে ; তারপরে তাদের বাসস্থল হিসেবে এক একটা বিশেষ বিশেষ অঞ্চলকে। যেমন, ‘রাঢ়’ বলতে এখনো বুঝায় মধ্য পশ্চিম বঙ্গ, ‘সুক্ষ’ বোঝাতে দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গ, ‘পুন্ড বর্ধনভুক্তি’ বোঝাতে মোটের উপর উত্তর বঙ্গের বঙ্গকে। অবশ্য এ ছাড়াও এক একটা অঞ্চলের অন্য নাম ছিল। যেমন, উত্তর বঙ্গকে পূর্বেও বলত এখনো বলে, ‘বরেন্দ্র’ ; ‘বঙ্গ’ বলতে বিশেষ করে বোঝাত পূর্ব বঙ্গ। বাংলা ভাষা কিন্তু অষ্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষাও নয়, দ্রাবিড় গোষ্ঠীর ভাষাও নয়, আর ভোট-চীনা গোষ্ঠীর ভাষার চিহ্ন তা এ ভাষায় নেই-ই বলা চলে। বাংলাভাষা আর্য (ইন্দো-এরিয়ান) গোষ্ঠীর ভাষারই বংশধর।

‘আর্য’ কথাটাই সম্ভবত মূলত একটা সংস্কৃতিতেই ছিল এক গোষ্ঠীর। খ্রীষ্টপূর্ব ১০০০ থেকে খ্রী ৫০০ অব্দের মধ্যেই তারা সম্ভবত প্রথমে এসেছিল বিদেহে, সগর্বে, পরে আসে অঙ্গে, তারও পরে বঙ্গে, কলিঙ্গে। যারা এসব দেশে প্রথম আসত, বসবাস করত তখনকার স্থানীয় ‘অন-আর্য’ অধিবাসীদের সাথে দ্বন্দ্ব চলত। তাই জাতি ও দেশের প্রধান এক পরিচয় ভাষা ; কারণ, ভাষা একটি মৌলিক সামাজিক বন্ধন, সংস্কৃতির এক প্রধানতম বাহন, জাতির মানসিক রূপেরও পরিচায়ক। আর্যদের বাংলায় আগমনের পূর্বে বঙ্গোপসাগরের তট ব্যাপী কতগুলো স্থান সমতট বলে পরিচিত ছিল। চৈনিক পরিব্রাজক যুয়ন চয়ঙের ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় তখন বিক্রমপুর সমতটাখ্যা হিসেবে বিক্রমপুর বা বঙ্গের অন্তর্ভুক্তি হিসেবে তখন এখানে গোষ্ঠীতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা ছিল। বেদের শাস্ত্রনুযায়ী জীবন অতিবাহিত হতো।

কৌলিণ্যপ্রথা বংশ পরম্পরা হিসেবে গণ্য হতো না। শিক্ষা ও কর্মের বিভাজনের উপর কৌলিণ্য প্রথা চালু ছিল। ভারতের আর্য সমাজ ব্যবস্থা বৈদিক রীতিতে প্রসার ঘটার পর বুদ্ধের ন্যায় ত্যাগী সন্নাসী পুরুষ ভোগ বিলাস ও দ্বেষ-হিংসা পরিত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মের বাণী প্রচার করতে থাকে। কিন্তু শ্রী শকরাচার্যের অভ্যুদয় বুদ্ধের সেই মানবতার অভয়বাণী ভারতে নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। পূর্ব বঙ্গের বিশেষতঃ বিক্রমপুরে কিরূপ বৌদ্ধধর্ম বিস্তার লাভ করে তার একটু প্রাচীন ইতিহাস আলোচনা করা প্রয়োজন। ৩৭২ খ্রী পূর্ব চন্দ্রগুপ্ত জৈন বতির শিষ্যত্ব নেয়ার বঙ্গদেশ থেকে বাহ্মাণচার এক প্রকার বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। চন্দ্রগুপ্তের পর মহারাজা অশোকের অভ্যুদয় হয় এবং অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে। অশোক বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য নানা দেশে ধর্ম প্রচারক প্রেরণ করেন। অশোকের সময় বঙ্গদেশের অবস্থা এতটা গৌরবজনক ছিল না। তার অধীনে বঙ্গদেশে বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত হয়ে সামন্ত রাজার উদ্ভব ঘটে। এই সময় থেকেই পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধধর্মের প্রচার হতে থাকে। মহারাজা অশোকের সময় বঙ্গের আধিপত্য বিস্তার না করলেও পাল রাজবংশের অভ্যুদয়ের সাথে সাথে বিক্রমপুর তাদের শাসনে চলে যায়।

এই পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হওয়ায় বিক্রমপুর তথা বঙ্গে বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব ঘটে। আর্য-অনার্য শব্দের সমন্বয়ে বিক্রমপুরে একটি প্রাচীন গোষ্ঠতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। সে সময় বিক্রমপুরের আর্থ সামাজিক অবস্থা সামন্তশ্রেণী ভুক্তি ছিল এবং কালী গঙ্গা নদী প্রবাহিত হওয়ায় কৃষি উৎপাদনে অত্র অঞ্চল খ্যাতির শীর্ষে ছিল। তখন সমতট বাসীদের প্রধান আহার ছিল ভাত মাছ। বিক্রমপুর তথা পূর্ববঙ্গে তখন রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্পদের বন্টন হতো এবং কড়ির বিনিময়ে সম্পদ ক্রয়-বিক্রয় চলত। বৈদিক মতে বিয়ে কার্যাদি সম্পন্ন হতো। গোষ্ঠীগুলো বেঁচে থাকার প্রয়োজনে পুকুর খনন, গুরুগৃহে শিক্ষা ব্যবস্থা এবং অর্থের জন্য কার্পাস চাষ করা হতো। এছাড়াও সূতা ও কাপড় তৈরী হতো। আড়িয়ল কাগজ শিল্প প্রসিদ্ধ ছিল। যে শঙ্খ শিল্প এখন ঢাকায় গৌরব, বিক্রমপুর তার জন্মস্থান কুস্বকারের হাঁড়ি-পাতিল, শত শত মাটির মূর্তি এবং সোনা-রূপার কাজেরও গৌরব ছিল। ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উন্নতির বিকাশে তখন বিক্রমপুরে একটি কারিগরী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে যা পরবর্তীতে শ্রমজীবি হিসেবে পরিচয় লাভ করে।

পাল নৃপতিগণ বৌদ্ধ ধর্মাবম্বী হলেও তারা ব্রাহ্মাণের প্রতি শ্রদ্ধাবান ছিলেন। পাল রাজারা বৌদ্ধধর্মের বিস্তৃতির জন্য চেষ্টা করলেও বৈদিক ধর্মই অধিকতর প্রতিষ্ঠাবান ছিল। তবে একথা ঠিক যে বৌদ্ধ ধর্মের তান্ত্রিকতা বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের কঠিন ও রীতিনীতির বহু পরিমাণে শিথিল করে ফেলেছিল। পাল রাজাদিগনের সময়ে হিন্দু সমাজের জাতিগত সংকীর্ণতা দূরীভুত হয়ে আর্য শক ও অনার্যদিগের মধ্যে একতার দৃঢ়তা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সে সময় বিক্রমপুরে প্রত্যেক জাতিই দ্বেষ ভাব ভুলে গিয়ে মিলনের স্বমহিমায় প্রত্যেকই আপনার ভাবতে শিখেছিল। বিক্রমপুরের ইতিহাস মূলত : সেন রাজাদের সময়ই পরিপূর্ণ হয়ে উঠে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, ধারাবাহিক শিল্প সংস্কৃতির উত্তরণ, কৌলিণ্য প্রথা এবং কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা ও বিচার কাঠামো সেন রাজাদের রাষ্ট্রীয় চিন্তা দর্শন। সেনবংশীয় রাজাদের সময় বিক্রমপুরের রামপাল বাংলার রাজধানী হয়ে উঠে এবং দ্বিতীয় বল্লাল সেনের সময় মুসলিম দরবেশ বাবা আদম রামপালের নিকটবর্তী আবদুল্লাহপুর গ্রামে কানাইচঙ্গ নামক স্থানের মসজিদে আশ্রয় নেন।

ঐতিহাসিকরা মসজিদের উপস্থিত থেকে ধারণা করেন সেন রাজত্বকালে রামপালে মুসলিম সভ্যতার উন্মেষ ঘটে। সেনবংশীয় রাজাগণের পূর্বপুরুষ দাক্ষিণাত্য থেকে বঙ্গদেশে আগমন করেন। তাদের বংশোদ্ভব বিক্রমসেনই বিক্রমপুর নগরের প্রতিষ্ঠতা এই সেন বংশের রাজা আদিশূর অত্যন্ত খ্যাতিমান রাজা ছিলেন। তিনি স্বয়ং গৌড়ের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। ‘‘বিষকূলকল্পলতা’’ বইয়ে উল্লেখ রয়েছে ‘‘বরেন্দ্র সেন’’ গৌড় রাজ্যের অধিপতি ছিলেন এবং তার নামানুসারে গৌড়দেশ ‘‘বরেন্দ্রভূমি’’ বলে খ্যাতি লাভ করে। সেই সময় রাঢ়, বঙ্গ সবই গৌড় বলে পরিচিত ছিল এবং তখন বঙ্গদেশের ভাষা গৌড়ীয় ভাষা বলেও চিহ্নিত ছিল। গৌড় ও বরেন্দ্রই পূর্বে পুন্ডদেশ বলে পরিচিত ছিল। আদিশূর শ্বশুরের সহায়তায় বীরসিংহ এবং পাল রাজাগণকে পরাজিত করে গৌড়ে স্বাধীনতা প্রাপ্ত হয়। এভাবেই প্রমাণিত হয় যে, বঙ্গদেশের রামপাল নগরীই আদিশূরের আদি রাজধানী। সেনরাজাগণ বৈদ্য ছিলেন, কানাকু্ব্জ হতে বাক্ষ্মাণ ও কায়স্থগণ বিক্রমপুরে আগমন, এজন্যই বিক্রমপুরে এই তিন জাতির প্রাধান্য দেখা যায়।

প্রসন্ন কুমার ঠাকুর ‘বেনীসংহারে’ বলেছেন, মহারাজ আদিশূর রাজধানী রামপাল প্রজাদের কল্যাণে যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনার জন্য কান্যকুব্জ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রণ করেন। নিমন্ত্রিত ব্রাহ্মণরা এসে রাজধানীর দু’কিলোমিটার দূরে আর্শীবাদের জল চিরশুষ্ক গজারি বৃক্ষে ছিটিয়ে দিলে বৃক্ষটি পুনরুজ্জীবিত হয় এবং ফল ও পুষ্পে সুশোভিত হয়। বর্তামানে মৃতপ্রায় গজারি বৃক্ষটি রামপাল মহাবিদ্যালয়ের পূর্বপাশে কালের সাক্ষী হিসেবে আজও দাড়িয়ে আছে। পরবর্তীতে রাজা আদিশূর ব্রাক্ষণদের তেজ ও অলৌকিক ক্ষমতায় খুশি হয়ে ব্রাহ্মণদের স্থায়ী বসবাসের জন্য বিক্রমপুরে ‘পঞ্চসার’, ‘পাঁচগাও’ নামে পাঁচটি গ্রাম দান করেন। সেই ব্রাহ্মরেদ সুবাদেই বাঙালী জীবনে জাতিপ্রথার গোড়াপত্তন হয় এবং বল্লাসেনের আমলে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। ফলে বিক্রমপুরে ‘‘স্বেচ্ছা’’, ‘‘যবনদের’’, জীবন কাঠামো শোষণ যন্ত্রণায় শোণিত হয়ে উঠে। বল্লাসেন রচিত ‘অদ্ভুদ সাগর’ গ্রন্থে সেন বংশের একটি ধারাবাহিক বংশ পরিচয় দিয়েছেন, আদিশুর (৯০০-৯৫২) ভুশূর পুত্র (স্বতন্ত্র) লক্ষীকন্যা (৯৫২-৯৭০) অশোক সেন (৯৭০-৯৮১) শূরসেন (৯৮১-৯৯৪) বীরসেন (৯৯৪-১০১২) সামন্ত সেন – হেমন্ত সেন বল্লাল সেন (১০৬৬-১১০১) ১ম লক্ষণ সেন (১১০১-১১২১) মাধবসেন – কেশব সেন ২য় লক্ষণ সেন (১১২৩-১২০৩) পর্যন্ত। মহারাজা বল্লাসেন আদিশূরের কন্যা কুলসজ্ঞাত। বঙ্গপ্রদেশ দু’জন বল্লাল সেন ছিলেন।

প্রথম বল্লাল সেন বিজয়সেনের পুত্র, দ্বিতীয় বল্লাল সেন – বেদসেন বা বিশকতাতের ঔরস পুত্র। এই উভয় বল্লালই বিক্রমপুরের সমৃদ্ধির সাথে জড়িত। ঐতিহাসিক জেসি র্মাস সেনস হিষ্ট্রি অব বেঙ্গল বিক্রমপুরের সমৃদ্ধির সাথে জড়িত। ঐতিহাসিক জে সি মার্স সেনস হিষ্ট্রি অব বেঙ্গল এ লিখেছেন, প্রথম বল্লাল সেন ১০৫০ খ্রী : রামপালের রাজা নির্বাচিত হয়ে বঙ্গদেশকে পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন। তিনিই বঙ্গে কৌলিণ্য প্রথার সৃষ্টি করেন এবং অসর্বনা ডোম কন্যার অন্নগ্রহণ করায় পুত্র লক্ষণ সেনের সাথে মতবিরোধ হয়। ডোম কন্যাকে বিয়ে করায় তখন অস্পশ্বহতার কারণে বিক্রমপুর থেকে অনেক কৌলিণ্য ব্রহ্মাণ চলে যায়। বল্লাল সেন মিথিলা আক্রমণের সময় বিক্রমপুরে বীরশ্রেষ্ঠ লক্ষণ সেনের জন্ম হয় এবং বল্লাল সেন মারা গেলে ১১৬৮ সালে লক্ষণ সেন পৈতৃক রাজ্য লাভ করেন। পরে লক্ষণ সেন রাজধানী বিক্রমপুর থেকে গৌঢ় বা লক্ষণাবর্তীতে স্থানন্তরিত করেন। তার রাজত্বকালে গৌড়ে প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিযুক্ত হন বাঙালী পশুপতি ও বৈদিক ব্রাহ্মণ হলায়ুধ। যাদের জন্মস্থান বিক্রমাপুর। গৌড়ে লহ্মণ সেনের রাজত্বকালে পুত্র বিশ্বরূপ সেন বিক্রমপুর পরগনার শাসনভার গ্রহণ করেন। ভারতব্যাপী তখন প্রজাবিদ্রোহ এবং সৈন্য বিদ্রোহ দেখা দেয় কিন্তু বিক্রমপুর তথা বঙ্গে সেই ধরনের কোন বিদ্রোহ দেখা দেয়নি। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।

লক্ষণ সেন স্বেচ্ছায় তীর্থযাত্রায় বের হলে কেশব সে বিক্রমপুরে আসেন এবং উদার মনের অধিকারী বিশ্বরূপ স্বইচ্ছায় জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কেশব সেনের কাছে বিক্রমপুরের শাসনভার দিয়ে দেন। বিশ্বরূপের শাসনামলে শাসন, শৃংখলা ও কর আদায়ের জন্য একটি পরগনাতি ‘সন’ প্রচলিত ছিল। যার দ্বারা রাষ্ট্রের সব কাজ নিয়ন্ত্রিত হতো। বিশ্বরূপ সেনের পর সেন বংশের কেউই আর খ্যাতি অর্জন করতে পারেনি। এরপর দ্বিতীয় বল্লালসেন বিক্রমপুরের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং বুদ্ধিমত্তার সাথে বিক্রমপুরের গৌরব আবার স্বর্ণ প্রদীপের মত জ্বালিয়ে তোলেন। প্রত্মতান্ত্রিক শিল্প ও ভাস্কর্যে বিক্রমপুর নগরীকে মহীয়সী করে তুলেছিল। ডঃ ওয়াইজের লিখিত এশিয়াটিক জার্নাল থেকে জানা যায়, দ্বিতীয় বল্লালসেন যখন বিক্রমপুরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন ১৩৭৮ সালে বাবা আদম নামে এক ইসলাম ধর্ম প্রচারক রামপালে উপস্থিত হন।

কথিত আছে তাপস শ্রেষ্ঠ বাবা আদমের সাথে রাজা বল্লাল সেনের যুদ্ধ বাঁধে এবং আত্ম রক্ষার জন্য বাবা আদম তার অনুচরসহ যুদ্ধে লিপ্ত হন। অষ্টাদশ দিবস যুদ্ধে রাজা বল্লালসেন পরাজিত হন। যুদ্ধক্ষেত্রে মাগরেবের নামাজ আদায়ের সময় বাবা আদম নামাজে মশগুল থাকলে সুযোগ বুঝে রাজা তরবারির আঘাতে তাকে হত্যা করে। আরও কিংবদন্তী আছে, বল্লালসেন শোণিত সিক্ত দেহ ধৌত করার জন্য নিকটবর্তী একটি সরোবরে যায় এবং সেখানে শিথিল বন্দনী থেকে কবুতর ছুটে রামপাল প্রাসাদে পৌছলে আত্মীয় পরিজন পরাজয়ের অনুশোচনায় কুন্ডলী জ্বালানো আগুনে আত্মাহুতি দেয় এবং রাজা দ্রুতবেগে ছুটে এসে তাদের রক্ষা করতে ব্যার্থ হয় এবং নিজেও আত্মীয় পরিজনের শোকে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। অতঃপর কাজী কসবাগ্রামের দূর্গাবাড়ীতেই সুলতান আহম্মদ শাহের পুত্র জামাল উদ্দিন ওয়াদদন সুলতান আবুল মুজাফফর ফতেহ শাহের আমলে মহান মালিক কার্ফুর কর্তৃক হিজরী মাসের মাঝামাঝি বাবা আদমের মসজিদটি তৈরী করা হয়। আজও সেই মসজিদে নামাজ আদায় হয়